ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) বেড়েছে মাদকের কারবারি। অনেক শিক্ষার্থী মাদকের কারবারির সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন উপায়ে মাদক সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। সন্ধ্যা হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্রিকেট মাঠ, ফুটবল মাঠেসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় মাদকের আসর। মাদকের দৌরাত্মের কারণ হিসেবে প্রশাসনের নিরব ভূমিকাকেই প্রশ্ন তুলছে অনেক শিক্ষার্থী
তাদের দাবি, ক্যাম্পাসের ভিতরে অনেক শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। নিত্য দিনই মাদক নিয়ে কোন না কোন ঘটছে। এসব সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন নবীন শিক্ষার্থীরা আসে তাদের বিভিন্ন হলের গণরুমে উঠানো হচ্ছে। তাদের নিয়ে কথিত বড় ভাইয়েরা মাদক সেবন করছে। মাদক সহজলভ্য দামে পাওয়ার ফলে নবীন শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
একের পর এক মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে এসে তারা বিভিন্ন উপায়ে মাদকসেবী চক্রের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই মাদকের নিয়মিত আসর বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্রিকেট মাঠে, বঙ্গবন্ধু হলের পুকুর ঘাট, ফটবল মাঠে, লেক এলাকা, মুক্ত বাংলা ভাস্কর্য এবং স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন জায়গায়। একের পর এক মাদক নিয়ে ঘটলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে নিশ্চুপ ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের।
গত ২৫ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে মাদক সরবরাহের সময় বহিরাগত এক মাদক ব্যবসায়ীকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে ইবি থানা পুলিশ। আটককৃত মাদক ব্যবসায়ী ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানার নুরুল জোয়ার্দারের ছেলে আনোয়ার জোয়ার্দার।
সম্প্রতি ২৩ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান কোরাইশি নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে ইবির মেডিকেলে নিয়ে যায়। পরে মেডিকেলের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে কুষ্টিয়া মেডিকেলে রেফার করে। এ ঘটনার পরের দিন জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর কথা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়ার বডির কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নয় বলে জানান।
এদিকে মাদক সেবনসহ আশিকের নামে রয়েছে মারধরের অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে নিউজও প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি গাঁজা কান্ডে মারধর করেন ইইই বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান জিয়াকে।
এদিকে গত জানুয়ারিতে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারান বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের দস্তগির নামের আরেক শিক্ষার্থী। পরে তাকে পূর্নবাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ঈদুল ফিতরের ছুটির পর তিনি ক্যাম্পাসে ফিরে ফের মাদক নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। গত ২৫ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাত্রাতিরিক্ত মাদক গ্রহণের ফলে তিনি আবারও মানসিক ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট আচরণ করছেন। এসময় বিশ্বিবদ্যালয় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত হয়ে তাকে মেডিকেল নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পুনরায় তাকে পূর্নবাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এদিকে মাদকদ্রব্য ব্যবসা পরিচালনায় অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। গত বছরের ২৪ মে ৮৯ পিস ইয়াবাসহ বিএনসিসি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর বকুল জোয়ার্দ্দারকে আটক করে র্যাব। এর আগে ২০১৭ সালে ২০ মে ২০০ পিস ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে আটক হয় ওই কর্মচারী। সে সময় তাকে সাময়িক বহিষ্কারও করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২০২০ সালে ২৩ জুলাই ঝিনাইদহের শৈলকুপা থেকে ৬৩ লিটার বাংলা মদসহ আটক হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চিত্তরঞ্জন ঘোষ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি চালক প্রল্লাদ শেখের ইয়াবা সেবনের দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
মাদক নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিয়াউর বহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, গাঁজা অনেক সহজলভ্য। এখন আমরা বাবা, ডাল, ঘুমের বড়ি, বিভিন্ন সিরাপ এবং দেশের বাহিরের নামি দামি ব্রান্ড খাই।
মাদক থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘খুব ইনটেনশোনালি মাদক সরবরাহ করা হয়। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করেছে। আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি। যারা এটা করে তারা নতুন প্রজন্মকে মেধাশূন্য করতে চায়।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন,
পিতা মাতা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায় আমার সন্তান একদিন মানুষের মত মানুষ হবে।
সেই স্বপ্ন অনেকের জন্য কাল হয়ে দাড়াচ্ছে মাদকের প্রভাবে। ফলে অকালেই ঝরে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেধাবী মুখ গুলো। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় মেধা শূন্য হয়ে পড়বে। এত ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষ যদি এই বিষয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক রুমে রুমে চলবে মাদকের আসর। এছাড়াও ইবির সুনাম নষ্ট করছে কিছু মাদকাসক্ত কর্মচারী। প্রশাসন মাদক কারবারিদের কাছে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এর থেকে কবে বের হতে পারবে কর্তৃপক্ষ তা প্রশ্ন রয়েই যায় শিক্ষার্থীদের কাছে!
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক পিয়াস বলেন, আমরা দেখেছি ক্যাম্পাসে মাদকের দৌরাত্ম চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোন জোরালো প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। যার ফলে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসা শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে মাদকের দিকে ঝুকে পড়ছে। কর্তৃপক্ষকে শক্ত অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে মাদক নির্মুলের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত ২৫ মে রাতে যে মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে তাকে রিমান্ডে নিয়ে এই চক্রকে বের করা হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর থেকে যে শিক্ষার্থীর তথ্য আমরা পেয়েছি তার অবিভাবকের সাথে অচিরেই কথা বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক চক্রকে রুখতে পুলিশ প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে, নির্মুল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলতেই থাকবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা মাদকের বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। ভিসি স্যার ঢাকাতে আছেন তিনি ক্যাম্পাসে আসলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করব। কিভাবে এই বিষয়ে শক্তিশালী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় এই চেষ্টা করব। আসলে ঘরে ঘরে অভিযান চালিয়ে তো মাদক নির্মুল করা যায় না এর জন্য প্রয়োজন কাউন্সিলিং। মাদকের সোর্স গুলো খুঁজে বের করেছি। ক্যাম্পাসে কিভাবে মাদকের প্রবাহ বন্ধ করা যায় এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করব।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।